Where Creativity Ends Up with Quality Services

টারটিলার সাথে একদিন

শনিবার, ২৩ মে ২০২০।

হঠাৎ চঠ করে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠেই বসে পড়লাম। মনে হল জৈষ্ঠ্যের কাঠফাটা খড়খড়ে রোদ আমায় ঝাপটা দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলেছে। বৈদ্যুতিক পাখারাও স্তব্ধ। কৃত্রিম প্রশান্তিরা নিস্তেজ নিনাদে। তাছাড়া বাচ্চাদের সারমেয় উল্লাস আর চিৎকার চেচামেচিও যেন রোদেলা উত্তাপের সাথে আঁতাত করে বসেছে, ঘুম ভাঙাতে হবেই! আধোবুঝা ক্লান্ত চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম টিনের ফাঁকফোকর দিয়ে সোনালী রোদ ঘরের চারদিকে এলিয়ে পড়েছে, যেন পাতানো আলোর ঝলমলানি। যাকগে, তাতে আমার কি! ছোট্ট এই জীবনে কতই আলো দেখলাম অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে। ফোন হাতে নিয়ে সময়ের দিকে তাকাতে মনে হল পৌনে দশটা বাজে। ঘুমের ঘুর কাটতেই মনে হল দিনটা মন্দ নয়- ঝরঝরে, ফকফকা। গত দুই দিনের কান্নাকাটি থামায় স্যাঁতসেঁতে ভাবটা অন্তত পালিয়েছে- মন ও পরিবেশ দুটো থেকেই। একটু বেরুনো যাবে, হাটাহাটি করা যাবে এইতো বেশ।

অভ্যাসবশত ডাটা অন করতেই, টুংটাং শব্দে বার্তা এলো মেসেঞ্জারে। টারটিলার বার্তা;

- “কেমনে সম্ভব?” কথাটা আমার “চৌক লাগি গেছিল”কথার প্রতুত্তরে বলেছিল সে, কিছুটা অবাক ভঙ্গিতে। কেননা আমি সেহরির আগে ঘুমাই না বলে জানত ও। না ঘুমানোর কারনও অবশ্য আছে, ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে উঠার পর চোখ জ্বালা আমার সহ্য হয় না।

- “চৌক মুঝলে চৌকও আরাম চায়।”, প্রতুত্তরে আমি বললাম।

- “টাউনো যাইতাম, এখলা এখলা ভাল্লাগের না। খেউ নাইও যে লগে লইয়া যাইমু!”, টারটিলা অপ্রস্তুত, নিরব নিঃসঙ্গ ভঙ্গিতে বললো।

- “ভাইতারার কেউ একজনরে লইয়া আও না তে!”

- “তারা দোকান লইয়া ব্যাস্ত খুব”

- “অহহ, এখলা আইতায় ফারবায়। ই পোস্টমডার্ন যুগও আওয়া যায়, তবে খেউ লগে আইলে ভালা”, কিছুটা অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে।

- “ফারি ত, আমি এখলা ওউ চলাফেরা খরি”

- “অহহ, তেতো অইলো। চৌকর লাগি আইরায় ত, না কিতা? না অন্য কোন কারনও আছে?”

- “চৌকর ডাক্তার ফাইতাম নায় বুলে, খবর লইছলাম। পার্সেল আনাত যাইরাম, এসএ পরিবহন থাকি।”

- “ও আচ্ছা! এর পরেও দেখবায় মিলে নি। আগে পার্সেল লইলিবায়। আর বাদে ডাক্তার একজনও দেখাইলিবায়।”

- “এখলা নু! কিলা লাগের!”, আবারো টারটিলার কথায় নিঃসঙ্গতা, সংকোচ আর দ্বিধা।

- “কিলা লাগের?”, আগ্রহ চিত্তে জিজ্ঞেস করলাম।

- “কিলা জানি! এখলা এখলা অইলে যেলা লাগে আরকি।”

টারটিলাকে সঙ্গ দিলে কেমন হয়! এই করোনার দিনে চারিদিকে মানুষের আনাগোনা কমই হবে। বিপদ-আপদ হতে সময় লাগে না। সুযোগ পেলে চামচিকাও ফণা তুলে ফোসফাস করে। তাছাড়া দিনটাও বেশ। নির্মেঘ, পরিষ্কার স্বচ্ছ আকাশ। মাস দুয়েক ধরে বাড়িতেই আছি, বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দিতে যবনিকা বসে গেছে। একটু বেরুলে কি এমন হবে! তাছাড়া মঈন ভাইও কল দিয়েছে কার্ডটা ডেলিভারি নেওয়ার জন্য। জটপট ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েই টারটিলাকে বললাম;

- “বুচ্চি, তে আইওই? সঙ্গ দিমু নে।”

- “হাছাও খইরা নি? তে আইওক্কা।” টারটিলার কথায় উচ্ছ্বাস স্পষ্ট। শুনে ভাল্লাগলো। অন্তত কথাটা পজিটিভলি নিয়েছে।

- “সত্যি খইরায় নি?”, নিশ্চিত হওয়ার জন্য রিপিট করলাম।

- “অয়!” হ্যাঁ সূচক সম্মতি আসল।

আরও কিছু কথা হল। ডাটা অফ করে, ফোনটা চার্জে দিলাম। আনোয়ারকে ডাক দিয়ে বললাম দরজাটা খোলার জন্য। আনোয়ার আমার ভাগ্নে, বড় বোনের একমাত্র ছেলে। যেমনি রোগাপটকা তেমনি শ্যামবর্ণের চেহারা সুরত। বয়স এগারো বারো হবে হয়তো। ক্লাস ফাইবে পড়ে, পড়ালেখায় খুবই অমনোযোগী। আমাদের সাথেই থাকে ওরা। তাদেরকে নিয়ে চার জনের ছোট পরিবার আমাদের। আমি, আম্মা এবং তারা মা-ছেলে।

সে যাইহোক, দরজা খুলতেই আলোর ফোয়ারা যেন উপচে পড়লো ঘরের মধ্যে। ফোন রেখে ফ্রেশ হতে গেলাম। সময় বেশি নেই, ইতোমধ্যে দশটা বেজে চলেছে। তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হলাম। আমাকে মাস দেড়েক পরে প্যান্ট পড়তে দেখে আম্মা জিজ্ঞেস করলেন;

- “যাইতে খই বেটা?”

- “সিলেট যাইতাম, ফোন আইছে কার্ড আনতাম ব্যাংক থাকি।”

- “হুশে যাইও” অসংকোচে বললেন আম্মা।

কিসের কার্ড? কোন ব্যাংক? পরে গেলে হয় না? এরকম কোন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় নি আমাকে। আমার আম্মার মত আম্মারা থাকার সুবিধা এটাই। তাদের কাছে অতিরিক্ত জবাবদিহি করতে হয় না। তারা এতো কিছু বুঝেন না বলেই বাইরে বের হতে দেখলে মনে করেন তাদের ছেলে মহৎ কোন কাজ করতে যাচ্ছে। কারন যাই হোক না কেন আর্শীবাদ দিয়ে যান অবিরত। তাড়াতাড়ি ফিরতে ভুল করিস না বলতে ভুল হল না আম্মারও। উঠোনে পা দিয়েই ভালো লাগল। স্যাঁতসেঁতে কাদাজল নেই, সব শুকিয়ে ধুলো প্রায়। খালিপায়ে কতই না কাদা মাড়িয়েছি জীবনে। কিন্তু আজ কয়দিনের তফাৎে, বলতে গেলে বছর চারেক হবে, সেই কাদা এতো কদর্য লাগে কেন! কংক্রিটের উপরতলায় থাকতে থাকতে মৃত্তিকার মায়া চুকে গেছে। জীবন এমনই, স্রোতের অনুকূলে বয়ে চলে, যেখানে যেমন। মনে মনে ভয় ছিল, এই করুন আকালে গাড়ি পেতে না জানি কতো বেগ পোহাতে হয়, কত সময় লাগে। কিন্তু না, ভাগ্যিস রাস্তায় বেরুতেই খালি সিএনজি পেয়ে গেলাম।

রাস্তাঘাটে গ্রামের মানুষ সীমিত আকারে চলাফেরা করছে। যদিও অনেকে মনে করে করোনা টরোনা এসব কিছুই না, সব সরকার ও তার চোর চ্যালাদের হালচাল। মনে মনে তারাও আতংকিত এবং লকডাউন যে মানছে না এমন নয়। কেউ কেউ আবার, “আমার কি ডর, খোদায় রক্ষা কর” ভাব নিয়ে অনায়াসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে যাইহোক, ১০ মিনিটে রামপাশা পর্যন্ত এলাম, ড্রাইভার ডানে যাবে কিন্তু আমার গন্তব্য বামে। বাধ্য হয়েই নামতে হল রামপাশায়। ভাড়া দিয়ে বুঝলাম করোনার জন্য ভাড়াটা দিগুণ হয়ে গেছে। আমাদের দেশে এমনটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, সম্ভবত সব দূর্যোগই আসে কিছু বাড়তি আয়-রোজগারের জন্য, দশ টাকার ভাড়া বিশ টাকা, তিশ টাকার জিনিস ষাট টাকা এই আরকি। সুযোগ বুঝে কাকে মেরে কে বড় হবে এমন ধান্দা সবারই থাকে। আমিও এর ব্যতিক্রম কি না জানিনা! এভাবেই রামপাশা থেকে লামাকাজি আর লামাকাজি থেকে তেমুখি পর্যন্ত যেতে পারলাম। নিরাপত্তার স্বার্থে হয়তো, এদিকের গাড়ি ওদিকে শহরে ঢুকতে দিচ্ছে না ট্রাফিক পুলিশ, শুধুই গাড়িগুলো কিন্তু। মানুষগুলো অনায়াসেই ঢুকছে। কি আইন! কি নীতি আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের! আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে ধরে না ভাই। তলা আছে ঝুড়ি নাই নাকি ঝুড়ি আছে তলা নাই বুঝি না। শহর শহরের মতই চলছে, জনে জনারন্য বলা যায়। শুধু শুধুই আমাদের মাঝপথে নামিয়ে এই হয়রানি। সবই চলছে ভিতরে বাইরে, মাঝখানে কিছু গাড়ি আটকা পড়ে এই আরকি ভাইরাস মোকাবিলার পন্থা।

যাকগে, আরেকদফায় সিএনজিতে করে আম্বরখানায় পৌছলাম সোয়া বারোটার দিকে। কত মানুষ, কত রং, কত ঢং! মানুষের কমতি নেই, ব্যবসা বাণিজ্যও চলছে পুরোদমে। রোদেলা মধ্য দুপুর, মাথার উপর রাগান্বিত সূর্যের রক্তচক্ষু। সবাই চলছে আপন গতিতে, কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না। তাকালেও লাভ নেই, চেনাকেও অচেনা মনে হবে। সবার মুখ মুখোশে আবৃত, চোখে আতংকের ছাপ, মনে অজানা ভয়। এ যেন প্রকৃতির প্রতিশোধ, সে আজ দুরন্ত, অনাবৃত। আজ আকাশ বড্ড নীল, স্বচ্ছ জলের মত, কোথাও কোথাও খন্ড খন্ড সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে । স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পাখিরা উল্লাসে নাচানাচি করছে, কনক্রিটের সৌচ্চ অট্টালিকার উপর দিয়ে উড়াউড়ি করছে নির্বিঘ্নে, যেন প্রকৃতি আজ তাদের দখলে।

এক মধ্যবয়সী চাচা মানুষের ভার বইতে বইতে ক্লান্ত-শ্রান্ত। রিকশা রেখে মসজিদের ছায়ায় জিরিয়ে নিচ্ছে একদম আমার পাশেই। ঘর্মাক্ত দেহে ঘামের গন্ধ স্পষ্ট। চামড়ার ভাজে ভাজে ঘামের ফোটা গড়িয়ে পড়ছে। তবুও পরস্পর বিরোধী মুখ ও মুখোশ অবলিলায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে আছে। তরুণ-তরুণী সামাজিক দূরত্বের কথা ভুলে গিয়ে হাতে হাত ধরে হাটছে। নিজেদের মধ্যে আবার দূরত্ব কি!

টারটিলাকে টেক্সট করলাম তার অবস্থান জানার জন্য। মিনিট তিরিশেক লাগবে পয়েন্টে পৌছাতে। তার কন্টাক্ট নাম্বার চাইলাম। কিছুক্ষণ পর নাম্বার দিল সে। কল দিতেই দেখলাম কল বেয়ারিং এক্টিভেট করা, মানে কল ঢুকছে না তার ফোনে। টেক্সট করে সেটা জানিয়ে আমার ফোন নাম্বার পাঠিয়ে দিলাম। এপেক্স এর শো-রুমের দিকে পা বাড়ালাম যাতে সময়টা কাটিয়ে দেওয়া যায় একটু আরামেই। পায়ের দিকে খেয়াল করে বুঝতে পারলাম পাদুকাখানার জীবন বিপন্নপ্রায়। নতুনের সন্ধান করতে লাগলাম শো-রুমের আনাচে-কানাচে। এসব ব্রান্ডের জুতা কিংবা ড্রেস আমার দ্বারা কিনা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারন আমার চয়েজ আর প্রাইসট্যাগ সর্বদাই পরস্পর বিরোধী, আমার প্রতিকূলে। যেটা ভালো লাগে হাতে নিয়ে প্রাইসটা দেখে আলতো করে জায়গামতো রেখে দেই। একটা জুতা খুব ভালো লাগলো, হাতে নিয়ে প্রাইসট্যাগ খুজে না পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে প্রাইস জানতে চাইলাম। সে বলল, “স্যার, ২২৯০ টাকা মাত্র, জুতাটা ভালোই চলেছে, এটাই লাস্ট পিস, নিয়ে নেন।” মনে মনে বললাম আমার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে রে ভাই!

- “হু, দেখছি”, বলেই দেখতে দেখতে চুপিচুপি বেড়িয়ে পড়লাম। কেনার মত টাকা ছিল পকেটে, সাহস ছিল না। নিজের কাছে এটা নিছক বিলাসিতা মনে হলো।

শো-রুমের বাইরে আসতেই টারটিলার ফোন;

- “হ্যালো, কোনানো তুমি? আইচ্ছো নি”

- “জি অয়, মসজিদর অপোজিটে সবজির দোকানর অনো”

- “ওকে, উবাও যেন আছো ওনো, আইরাম” ফোনটা রেখেই টারটিলার দিকে আগানো শুরু করলাম। রাস্তার ওপাশ থেকেই বুঝতে পারলাম ও দাড়িয়ে আছে ঠিক মসজিদ গেটের অপোজিটেই। পড়নে সাদা স্টেপের বোরকার মত কিছু একটা, মুখে নেকাব, মাঝারি উচ্চতা। রাস্তা পার হয়ে সুজা তার কাছে চলে গেলাম। আস্তে করে ডাক দিলাম। সে এগিয়ে এলো। চেহারা দেখা যাচ্ছে না তবুও অপ্রস্তুত ভাব ফূটে উঠেছে চোখের রেখায়। উঠাই স্বাভাবিক। জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে বললাম, “ভালা আছো নি?”

- “জি আছি।” আস্তে করে বলল সে। কথার স্বর স্পষ্ট, কন্ঠে মায়া আছে।

পরক্ষণেই আমি কাজের কথায় মোড় ঘোরালাম। রাস্তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম;

- “এস এ পরিবহন কোন জাগাত?”

- “নাইওরপুল”, এক কথায় উত্তর দিল সে। তখনো অপ্রস্তুত ইতস্তত ভাব ছিল গলার স্বরে।

- “রিকশা ডাকতাম নি?”

- “রিকশা ছাড়া আর কিচ্ছু ফাইতাও নায়”, মাথা নেড়ে সম্মতি দিল টারটিলা।

সময় ক্ষেপণ না করে রাস্তার অপর পাশে থাকা অটোরিকশার দিকে পা বাড়ালাম। টারটিলাও আমাকে অনুসরণ করছে দেখে ভালো লাগলো। রোদের তীব্রতা যেন আরও বেড়েছে। প্রায় সারিবদ্ধ ভাবে থাকা রিকশা- অটোরিকশার চালকরা জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকে পথচারীদের দিকে। ক্লান্ত, অবসন্ন চেহারা হলেও যাত্রী উঠার আগ পর্যন্ত স্বস্তি ও প্রশান্তির ছাপ বিদ্যমান তাতে। যারা একটু ফর্সা তারা রোদের উত্তাপে টকটকে লাল হয়ে গেছে আর যারা শ্যামলা তারা ফ্যাকাসে, ধূসর বর্ন ধারণ করেছে, কিন্তু যারা কালো তাদের চেহারা যেন ঝলমলে, চিকচিক করছে। একটা অটোরিকশা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল কিন্তু কাছে পৌছানোর আগেই অন্য এক যাত্রী সেটা লুফে নিল। রাস্তার ওপাশে থাকা একটা অটোরিকশা ডাকলাম। মনে হল সে ওখান থেকেই কি যেন বলছে, কথার স্বর আমার কানে না পৌছালেও ঠোঁটের ভঙ্গিতে বুঝে নিলাম কোথায় যাব জানতে চাচ্ছে। একটু উচ্চস্বরে বললাম, “নাইওরপুল যাব।” সে রিকশা নিয়ে এগিয়ে আসছে দেখে মনে হল কথাটা তার কানে ভালোভাবেই পৌছেছে। যাক, আমার গলাটা বেশ চওড়া আছে! ইতোমধ্যে রিকশাটা নিয়ে একটা

কিশোর আমাদের কাছে চলে এসেছে। বয়স কুঁড়ি বছরের বেশি হবে না। গায়ের রং বাদামি গোছের। শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ না। টারটিলাকে রিকশায় আগে উঠতে বললাম। সে কথামতো রিকশার ডানপাশে উঠে বসল। পরক্ষনে আমিও উঠে বসলাম তার বামপাশে। আমি উঠে বসতেই টারটিলা আরকেটু ডানে সরলো যেন। উভয়ের মাঝখানের ইঞ্চি দুয়েক ফাকা যায়গা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলো। রিকশা চলতে শুরু করল। আমরা তিনজনই নিরব। দুজন বসে আছি আর একজন গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় ব্যাস্ত। আমি কি বলব তাই ভাবছিলাম হয়তো। টারটিলাও মনে হয় তাই করছিল। পয়েন্ট অতিক্রম করার পর কোলাহল কমতে শুরু করল। সুনসান নিরবতা। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। হঠাৎ রোদও যেন মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য মেঘের আড়ালেই চলে গেল। শান্ত, সুনিবিড় পরিবেশ। প্রশান্তিদায়কও বটে। নিরবতা ভেঙে আমিই বলে উঠলাম;

- “আইতে কোন অসুবিধা অইছে না ত?”

- “জি না, তবে একটু লেইট অইছে, যাত্রী পুরা অওয়ার লাগি অপেক্ষা খরা লাগছে, অউ যা”

- “আফনে আইছইন কোন সময়?”

- “তুমি আওয়ার আধা ঘন্টা আগে মে বি”

এভাবে রিকশার পাশাপাশি কথাও চলতে থাকল। এই-সেই, ইতি-উতি, আদি-অনাদি আরও কত কথা। আকাশ তার রং পাল্টালো যেন। কালোমেঘে ঢাকা পড়ল নীলাকাশ। এ যেন বৃষ্টির ঘনঘটা। কয়েকটা বৃষ্টির ফোটাও যেন আমাদের উপর পড়লো। একটু আগের উত্তাপ আর নেই পরিবেশে। আমরা রিকশায় বসে আছি, শান্তির বাতাস বইছে, দু এক ফোটা বৃষ্টিও সঙ্গ দিচ্ছে। আমাদের চিরায়ত সাধারণ কথাবার্তা চলছে। সব মিলিয়ে একটা রোমান্টিক আবহ তৈরি হল যেন। কিন্তু না, আমাদের মধ্যে এর সংক্রমণ ঘটেনি, শুধু পরিবেশটা এমন ছিল। আমরা দেহ মনে সুর ও শালীনতা বজায় রেখেই চলছি। সবচাইতে মজার (কিংবা ভয়ঙ্করও বলা যায়) বিষয়টা ঘটল তখনই।

নাইওরপুল আমাদের দুজনের অচেনা নয়। কিন্তু ব্যাপারটা এমন হল, ঐ মুহুর্তে পথঘাট তেমন ধর্তব্যে ছিল না আমাদের। আমরা যে স্বাভাবিক কথোপকথন করছিলাম যেন ওতেই নিমগ্ন দুজন। কখন যে নাইওরপুলের পয়েন্ট অতিক্রম করে আমাদের অজানা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কুঁড়ি বছরের ঐ চালক কিশোর, আমরা তা খেয়ালই করি নি। নাইওরপুল যাব বলেই কিন্তু তার রিকশায় উঠেছিলাম। যখন রিকশার চাকা মিরা বাজার অতিক্রম করতে লাগল তখন আচমকাই আমার মনে প্রশ্ন জাগল নাইওরপুল ত মিরা বাজার পরে হওয়ার কথা না। কারন ভার্সিটি ভর্তি কোচিং করার সময় আমি শিবগঞ্জ এবং মিরাবাজারের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত রায়নগর আবাসিক এলাকায় চার মাস থেকেছি। সেই সুবাদেই ওদিককার পথঘাট আমার চেনাজানা। যাইহোক, মনের প্রশ্ন মনেই রাখলাম এই ভেবে যে হয়ত অন্য কোন রাস্তা আছে যা আমাদের জানা নেই। দেখি কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। সংশয় আর নাইওরপুলের রাস্তা ভুলে যাওয়ার চিন্তা মাথায় কিলবিল করছিল। টারটিলাও এ বিষয়ে কোন কথা বলছে না কেন! নাকি সে ও আমার মতোই ভাবছে। সে অবশ্য বলেছিল এসএ পরিবহন থেকে এর আগেও পার্সেল নিয়েছে। তাইলে!

এসব ভাবতে ভাবতেই রিকশা দাদাপীরের মাজার অতিক্রম করে ফেলল। সামনে শিবগঞ্জ পয়েন্ট। আমিও প্রস্তুতি নিলাম ও কোন দিকে নিয়ে যায় আমাদের দেখব বলে। আমি ভাবলাম, পয়েন্টের ডানের রাস্তায় মোড় নিয়ে হয়তো নাইওরপুল যাবে এজন্যই সে এই লম্বা চক্কর দিল দুপয়সা বেশি নেবার জন্য। কিন্তু না, সে ডানে মোড় না নিয়ে সুজাই চলল। এবার তার মতিগতি আমার ভালো ঠেকল না, ধমক দিয়ে বললাম “এই মিয়া কই যাও এদিকে? নাইওরপুল এদিকে আসল কোথায় থেকে”

মনে হল তার ঘোর কেটেছে, “আপনেরা কিছু বলছেন না, কোন দিকে যাবেন”

আবারো ধমক দিয়ে বললাম, “তোমাকে ত বলেই উঠলাম নাইওরপুল যাব। আবার বলতে হবে কেন? রিকশা ঘুরাও”

সে সাথে সাথেই রিকশা ঘুরিয়ে চালাতে শুরু করল। কোন কথা নাই তার মুখে, একেবারে নিশ্চুপ। তার নিস্তব্ধতায় আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। রিকশা আসল গন্তব্যের দিকেই ছুটছে এবার। গলা নামিয়ে বলা শুরু করলাম;

- “ভাই এবার বল ত তর মতলব কি ছিল, তুই নাইওরপুল অতিক্রম করেই এতো দূর চলে গেলি আবার থামার কোন ইচ্ছাই নাই, কোথায় নিয়ে যেতে চাইছিলি আমাদের? উদ্দেশ্যটা কি বল?” তার কোন উত্তর নেই। সে নিস্তব্ধ। যেন বোবা বনে গেল কিছুক্ষণের জন্য। মনের সাথে কথা বলছিল হয়তো। কি জানি কোন ঘোরে ছিল, কোন সুখ কিংবা শোকের স্মৃতি রোমন্থন করছিল হয়তো! হয়তো ভালোবাসার কোন মধুর স্মৃতিতে নিমগ্ন ছিল বলেই গন্তব্য ভুলে গিয়েছিল, আমার কথায় সম্বিত ফিরল। নিজেই মাঝেমধ্যে হারিয়ে যাই অজানায়, বেখেয়ালে পড়ে থাকে পঞ্চইন্দ্রীয়। টারটিলাও শুনে যাচ্ছে, কোন কথা বলছে না দেখে জিজ্ঞেস করলাম;

- “তুমিও দেকি কিচ্ছু মাতো না, কোয়াই থাকি কোয়াই লইয়া যার হে বেটায়”

- “আমারও অলা লাগছে, অতো দূরই যায় দেইক্কা। ভাবছি অন্য কোন রাস্তা অইয়া যাইবো” তার গলার স্বর স্বাভাবিক। তেমন কোন ভাবান্তর নেই। যাক, ডরভয় পায় নি তাইলে! মৃদুমন্দ বাতাস, চলন্ত মোটরের শব্দ আর রাস্তার দু'ধার যেন ভালো লাগছিল ওর। রিকশা রায়নগরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওখানে থাকার অভিজ্ঞতার কথা বলতে লাগলাম। দু'জনের মধ্যে অনেক কথা হল এ নিয়ে। সে ও তার ভার্সিটি কোচিং এর কথা বলল। ইতোমধ্যে রিকশা নাইওরপুল পয়েন্টে পৌছাল। এবার কিশোরের মুখ খুলল, - “ কোথায় নামবেন আপনারা?”

- “এসএ পরিবহনের সামনে যাও” টারটিলা জবাব দিল।

কিশোর আর কোন কথা বলল না। মনে হল সে জায়গাটা চিনতে পারছে। পয়েন্ট অতিক্রম করেই হাতের ডানে এসএ পরিবহন। তার একটু আগেই একটা ছোট্ট কালবার্ট, ড্রেনেজ ব্রিজ বলা যায়। নতুন বানানো হয়েছে বিধায় রাস্তার দু'পাশের সাথে পাকা সংযোগ নেই। রাস্তা থেকে একটু উঁচুতে ব্রিজটা। কিশোর সটানে রিকশা নিয়ে ব্রিজে উঠতে চাইলে একটা বড়সড়ো ঝাকুনি খেলাম আমরা। ছোটখাটো দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। টারটিলা রিকশা থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম ছিল প্রায়। ভাগ্যিস সে তৎক্ষনাৎ রিকশার হুডে ঝাপটা মেরে ধরেছিল, আমিও থাকে কিছু না বোঝার আগেই ধরে ফেলছিলাম। এ যাত্রায়ও আমরা বেঁচে গেলাম আল্লাহ সহায় বলে। পড়ে গেলে নির্ঘাত চোট লাগত টারটিলার গায়ে।

- “কি মিয়া, একটু দেখেশুনে চালাবে না! ও যদি পড়ে যেত!” একটু ধমকের সুরে বললাম। তার কোন সাড়াশব্দ নাই। রাগ মিটে গেল। তর্ক করে নি ছেলেটা কোথাও। অনর্থক কথা বলা হয়ত পছন্দ করে না সে। নয়তো তার মন আজ কোন কারনে করুনাক্ত, দুঃখ ভারাক্রান্ত। ব্রীজটা রাস্তা থেকে অন্তত আধাহাত উচুতে হওয়ায় আমরা নেমে পড়লেও রিকশা তুলতে বেগ পেতে হচ্ছিল তাকে। আর রিকশায় উঠলাম না কারন কয়েক কদম পা চালালে আমরা রিকশা ছাড়াই গন্তব্যে যেতে পারব। টারটিলা চালাকি করে ভাড়া মিটিয়ে দিতে চাইছিল। বেচারিকে সে সুযোগ দিলাম না।

- “কত ভাড়া?” জিজ্ঞেস করলাম কিশোরকে।

- “দিয়ে দেন যা মন চায়” নির্মোহ ভঙ্গিতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে জবাব দিল সে। ওয়ালেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিতে চাইলে সে বলল,

- “ভাঙতি নেই, ভাঙতি দেন।”

অনেক খুজে টুজে ওয়ালেটের চিপা থেকে বের করে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট হাতে ধরিয়ে দিলাম। সে সহাস্যে বলল,” রেখে দেই পুরোটা?” কথাটা আমার ভালো লাগল। তার প্রাপ্য সে নিবে, অনুমতি চাওয়ার কিছু নেই। আম্বরখানা থেকে নাইওরপুলের ভাড়া বিশ-পঁচিশ টাকার বেশি হওয়ার কথা না। কিন্তু এই করোনাকালে সবাই বেশি ভাড়া নিচ্ছে, সেও নিবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া সে আমাদের নিয়ে অনেক ঘুরেছে, সময় নষ্ট করেছে, যদিও এর মধ্যে কুমতলব থাকতে পারে। যাইহোক, সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে থাকে বিদায় দিয়ে আমরা রাস্তা পার হয়ে এসএ পরিবহনের দিকে আগালাম। সেখানে ঢুকে লম্বা লাইনে দাড়াতে হল টারটিলাকে। লাইনে দাড়ানো কেউ একজন জিজ্ঞেস করলো,- “পেইড না আনপেইড ডেলিভারি?”

- “পেইড” টারটিলা জবাব দিল।

- “তাহলে ঐ লাইনে গিয়ে দাড়ান” লোকটা ঘরের ভিতরের ছোট লাইনটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। নিঃসন্দেহে লোকটা আমাদের উপকার করলো, তা না হলে শুধু শুধুই সময় নষ্ট হত। আমি পাশেই দাড়িয়েছিলাম, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পেইড অর্ডারের ডেলিভারি নিল টারটিলা। অবাক করা বিষয় হল এত বড় একটা প্রতিষ্ঠান এটা কিন্তু একটা ব্যাগের মধ্যে পার্সেল ঢুকিয়ে দিল না। যে প্যাকআপ করা পুটলি পার্সেল করা হইছে সেটাই হাতে ধরিয়ে দিল। যেটাকে বগলে আগলে রাখা ছাড়া উপায় নাই। সব জায়গায় পুঁজিবাদী মনমানসিকতা, ব্যাবসার মাধ্যমে সেবাও যে করা যায় সেটা আজকাল ধর্তব্যের বিষয় না।

টারটিলার আরেকটা আনপেইড পার্সেল ডেলিভারি নিতে হবে। বেচারি আগে এ কথা বললে নতুনভাবে এই লম্বা লাইনে আবার দাড়াতে হত না যেহেতু প্রথমেই এই লাইনেই দাড়িয়েছিল। আমি ততক্ষণ দাড়াতে পারতাম লাইনে, আমাদের সময় বাঁচত। ঐ যে বলেনা, “মেয়েদের বুদ্ধি হাটুর নিচে” তাই প্রমাণিত হল। সে লাইনে দাড়ালো আর আমি তার হাতের পুটলিটা নিয়ে বারান্দায় একটা মোড়ার মধ্যে আরামে বসে রইলাম। মিনিট দশেকের মধ্যে ডেলিভারি নিয়ে রওনা দিলাম আম্বরখানার উদ্দেশ্যে। গেইটে দাড়িয়ে থাকা আঙ্কেল দুইটা পার্সেলের দুইটা রশিদ জমা নিলেন। তাকে বললাম, “চাচা, একটা ব্যাগ-ট্যাগ দিলে হত না! টাকা না হয় আমরাই দিতাম”

- “পুটলিটার প্যাকআপ খুলে ফেল ব্যাগ ত আছেই” চাচা মুচকি হেসে বুদ্ধি বাতলে দিলেন প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গিয়ে। সত্যি ত! প্যাকআপ খুললে বিল্টইন ব্যাগ আছে, আর বগলে রাখতে হবে না। প্যাক খুলতে খুলতে টারটিলাকে জিজ্ঞেস করলাম,

- “এখন খই যাইতাম? ডাক্তার দেখাইতায় আও”

- “আমারে রোজায় ধরিলিছে, আজকে ফারতাম নায়, খানা অইগেলে অইগেলাম” অবসন্ন স্বরে বলল সে। আকাশ আবার নির্মেঘ, সূর্য যেন আরও কাছে চলে এসেছে। যা গরম, ক্লান্তি ত আসবেই।

- “আউ, তে কিচ্ছু খাইলিবায়, বুক লাগছে যেহেতু” রসিকতার সুরে।

- “জবাব দিমু কিতা আল্লার গেছে, হাশরের দিন ধরলে”

- “আল্লারে খইবায় বেশি বুক লাগি গেছিল, সহ্য খরতায় ফারছো না” মৃদু হেসে বললাম। মনে হল সেও মুচকি হেসে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিল যদিও তার মুখে নেকাব পড়া।

রিকশা ডেকে রিকশায় উঠলাম আমরা। রিকশা চলল আম্বরখানার উদ্দেশ্যে। প্রচন্ড রোদ পড়েছে। রিকশার হুড লাগানো। আচমকা বাতাসও যেন উধাও। তবুও এখন আমরা অনেক স্বাভাবিক। কথোপকথন চলছে, রিকশার চাকাও ঘুরছে। এমন কারও সাথে এই প্রথম রিকশাচড়ার অভিজ্ঞতা অবশ্যই রোমাঞ্চকর, অন্তত আমার কাছে।

- “বিষয়টা এখনও আমারে ভাবার” ইতস্ততভাবে বললাম আমি।

- “কোন বিষয়?” জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে তাকালো সে।

- “হারাখ হারাখ ভুলি গেছো নি?”

- “একসিডেন্টর কথা খইরা নি!”

- “না না, ছেলেটার কথা, এতো গম্ভীর প্রকৃতির, আমার মনে অয় না কোন খারাফ উদ্দেশ্যে হিবায় লইয়া গেছে”

- “তে আর কিতা উদ্দেশ্য অইতো ফারে!”

- “বেশি ঘুইরা টেখা একটু বেশি নিবার ধান্দা খরছে মনে অয়”

- “অইতো ফারে”

- “কুমতলবর কথাও মাথা থাকি যার না। বেশি গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ কিন্তু ভয়ঙ্কর অয়। আর এর ত উঠতি বয়স, গ্যাং ট্যাং থাকাটা অস্বাভাবিক নায়। আমার মনে অর হে তার নিরাপদ জাগাত আমরারে লইয়া যাইতো আছিল। ভাবছে আমরা পথঘাট চিনি না। সুযোগ ফাইলে এরা কিন্তু ভয়ঙ্কর অইতো ফারে। যাক, আল্লায় বাঁচাইছে কোন ঝামেলাত ফড়ছি না।”

- “আফনে হুদাও চিন্তা খররা ইতা কিচ্ছু নায়”

- “না অইলে ভালা, ছেলেটারে আমার ভাল্লাগছে, কম মাতে”

- “জি অয়”

- “আমরা আজকে দুইটা ফাড়া থাকি বাঁচলাম! “

- “অয়, আমি ত তুরার লাগি ফড়িগেছলাম অউ, যে ঝাকুনি মারছে।”

- “হু”

কথারা শেষ হতে না হতেই রিকশা আম্বরখানা পৌছাল। ঝাঁঝালো রোদে শহর যেন পুড়ছে। তবুও থেমে নেই কেউ, কোন কিছু। লোকে লোকারণ্য চারদিক। কোবিড-১৯ এর জন্য দেওয়া সীমিত লকডাউন মানছে না কেউ। আর মানবেই বা কেন! পড়শু যে ঈদ। জীবনের চাইতে ঈদ বড়। তাইতো সীমিত আকারে কেনাকাটাও করতে হবে। তাছাড়া এসব করোনা টরোনা ডরে না বাঙালি। যে মরার সে মরবেই। রাষ্ট্রের অনেক বড় বড় কর্তারাও তাই বলছেন। এটা একটা নিরিহ ক্ষুদ্র ভাইরাস।

ফুটপাতে থোকা থোকা লিচুর ঝুটা নিয়ে বসে আছে ব্যাবসায়ীরা। টারটিলার চোখ লিচুর দিকে,

- “ইতা লেছু ভালা অইবো নি?”

- “অইবো দেইক্কা লইলে” জবাব দিলাম। ইতোমধ্যে রিকশা আম্বরখানা মসজিদর সামনে চলে গেছে।

- “হউ দোকানর লেছু ফাখনা দেখা যার, ভালা অইতো ফারে” আঙুলের ইশারায় রাস্তার ওপাশের কর্নারের ফলফ্রুটের দোকানটা দেখালো সে। আমাদের সেখানে নামিয়ে দেওয়ার কথা বললাম মামাকে। ভাড়া মিটিয়ে দোকানের লিচুগুলা দেখে একটু দামাদামি করে অন্য দোকানে গেলাম আমরা। কিন্তু এর চাইতে ভালো লেছু না পাওয়ায় ঐ দোকান থেকেই লিচু আর আপেল কিনে সোজা টারটিলার সিএনজি স্টেশনে গেলাম। তার জন্য একটা সিএনজি দেখলাম। সিএনজি ছাড়ার আগে ছায়াতে খানিক্ষন জিরিয়ে নিলাম আমরা। সে সিএনজিতে ওঠলে চলতে শুরু করলো ওটা। সহাস্যে টারটিলাকে বিদায় জানালাম। মুখে মুখোশ থাকায় হাসিটা সম্ভবত দৃষ্টিগোচর হল না তার। সেও বিদায় নিল কিন্তু তার অভিব্যক্তি চোখেই প্রকাশ পেল। যেহেতু তার মুখেও এক ধরনের মুখোশ ছিল। কিছু সময়ের মধ্যেই সিএনজিটা দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে গেল। আমিও চিরচেনা নীড়ের উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলাম।